ফাতিমা তুজ-জান্নাত অনন্যা
[টেলিভিশনের চ্যানেল ঘোরাতেই হঠাৎ চোখে পড়লো বাংলাদেশের পুরোনো দিনের একটি বিজ্ঞাপন। পিছনে চলছে মৃদু সুরে একটি গান- “জানিনা, জানিনা, কেনো এমন হয়, তুমি আর নেই সে তুমি”। সিলন চায়ের বিজ্ঞাপনটি একসময় খুব দর্শকনন্দিত ছিলো। এক কাপ চায়ে কাটিয়ে দেওয়া কিছু মুহূর্তের সংমিশ্রণ সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়। অতঃপর বেশ উৎসাহের সহিত চায়ের উৎপত্তি সম্পর্কিত কয়েকটি ভিডিও দেখার এক পর্যায়ে সামনে এলো ‘The song of Ceylon’ তথ্যচিত্রটি। আগ্রহ নিয়ে দেখা শুরু করলাম। অতঃপর একদিন স্নাতকোত্তর পর্বের অন্তর্গত কোর্স দৃশ্যগত নৃবিজ্ঞানের একটি পাঠ্য হিসেবে কোর্স শিক্ষক তথ্যচিত্রটি দেখার পরামর্শ দিলেন। পুনরায় দেখতে দেখতে সিদ্ধান্ত নিলাম তথ্যচিত্রটি নিয়ে একটি পর্যালোচনা করলে মন্দ হয় না। ]
১. সালটা ১৯৩৪। তখনো টেলিভিশনের পর্দায় রঙের ছোঁয়া লাগেনি। সাদা কালোর আস্তরণে ব্রিটিশ তথ্যচিত্র ‘The song of Ceylon’ দর্শকের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বেসিল রাইট যিনি ছিলেন একাধারে একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র ইতিহাসবেত্তা, চলচ্চিত্র সমালোচক ও শিক্ষক, তাঁর পরিচালনায় এবং স্কটিশ তথ্যচিত্র নির্মাতা, ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান তথ্যচিত্রের জনক- জন গ্রেয়ারসনের প্রযোজনায় শ্রীলংকায় নির্মিত হয় তথ্যচিত্রটি। পরবর্তীতে ডাবিং ও শব্দের প্রয়োগ, মিউজিক এবং তথ্যচিত্রটির ধারণকৃত নানা অংশের সংযোজন বিয়োজনের কাজ সম্পন্ন করা হয় লন্ডনের ব্ল্যাকহেথ অঞ্চলে GPO Film Studio তে। উল্লেখ্য, সে সময় তথ্যচিত্রের ক্যাটাগরিতে এটি প্রথম স্থান দখল করে নেয় এবং ব্রিটিশ বোর্ড অব সেন্সর কর্তৃক অনুমোদিত ৩৯ মিনিট ৪২ সেকেণ্ডের এই তথ্যচিত্রটি দ্বারা সিলনে বসবাসকারী তৎকালীন জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক এবং এর সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের মেলবন্ধন আমাদের চোখে পড়ে। ৪ ভাগে বিভক্ত তথ্যচিত্রটি ভিন্ন ভিন্ন কিছু আঙ্গিকে দর্শকের মনোরঞ্জন করে চলেছে। দৃশ্যগত সে ধারাবাহিকতাকে শাব্দিক বর্ণনায় উল্লেখ করার প্রয়াস রয়েছে পুরো পর্যালোচনা জুড়ে।
The Buddha:
প্রথমে আসি, ‘The Buddha’ অংশ বিশেষে। এই পর্বটির স্থায়ীত্বকাল ১ মিনিট ২৪ সেকেন্ড থেকে ১০ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড পর্যন্ত। সিলনের গাছপালা ও প্রাণীকে প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তথ্যচিত্রটি। সিলনের নিজস্ব রীতি অনুসারে অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত ঢাকঢোল সহযোগে নৃত্য দ্বারা তাদের সংস্কৃতিকে উপস্থাপনের চিত্র ভেসে ওঠে। মুখোশের ব্যবহার অভ্যন্তরীণ বার্তাবহনের কাজ করে থাকে। পরবর্তীতে মানুষের প্রয়োজনীয় নিজস্ব জিনিসপত্র সমেত তীর্থযাত্রার অংশটি তুলে ধরা হয়েছে যেখানে শ’ শ মানুষকে প্রতিকূল দীর্ঘপথ অতিক্রম করে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে সন্তুষ্টি অর্জন বা মনোকামনা পূরণের আশায় পূজা অর্চনা করতে দেখা যায়। সুপেয় পানি পানের মধ্য দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের বিশ্বাসটিও লক্ষ করা যায়।
পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে সিলনের বিভিন্ন বয়সী (বাচ্চাসহ বয়স্কদের) বাসিন্দাকে উপরে গমণ করে বিশ্রাম নিতে দেখা যায় এবং এরপরই শুরু হয় পূজার যাবতীয় নিয়মাদি। একজন মধ্যবয়স্ক লোক ধর্মীয় মন্ত্র পাঠ করতে থাকেন এবং মনোযোগ সহকারে তা শুনতে থাকেন তীর্থযাত্রায় গমণকারী সকলে। বারংবার বৌদ্ধমূর্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় ধর্মকে পালন করতে তারা মূর্তিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। পুরোনো ঐতিহাসিক নানা নির্দশনের পিছনের ইতিহাস এবং তার সাথে ধর্মের নিগূঢ় যে সম্পর্ক তা জানার নিমিত্তে ভ্রমণ করেন তারা। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আরম্ভ হয় পূজার কার্যক্রম। ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের ব্যবহার পূজাতে ব্যবহার করতে দেখা যায়। ঘন্টা বাজানোর মাধ্যমে স্তুতির বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। তথ্যচিত্রটির ১০ মিনিট ৮ সেকেন্ডে পরিচালক বহমান নদীর পাশে বাড়ন্ত একটি গাছের শুকনো ডালে বসে থাকা মাছরাঙা পাখিকে দেখিয়েছেন এবং সময়ের ব্যবধানে তার উড়ে চলার চিত্রটিও সংযুক্ত করে প্রথম অংশটি শেষ করেছেন তিনি।
The Virgin Island:
তথ্যচিত্রটির ২য় অংশটি শুরু হয় ১০ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড থেকে যার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে – ‘The Virgin Island’। নারিকেল গাছের প্রভাব সিলনের জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক হারে দেখা যায়। সেখানে স্থানীয় নানা পদ্ধতির মাধ্যমে পানি উত্তোলনের চিত্র দ্বারা পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন নারী পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ বিদ্যমান। শিশুদের গোসল থেকে অন্যান্য প্রাণীকূল যেমন- হাতির প্রয়োজনেও পানির ব্যবহারের চিত্র ধারণ করেছেন তিনি। গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত ছিলো সাহায্য চাইতে আসলে পূর্বে টাকার পরিবর্তে চাল দেওয়ার প্রথা, সে দৃশ্যপট ফুটে ওঠে তথ্যচিত্রটিতে। যেখানে সাহায্যের জন্য একজন লোক আসলে তাকে শস্য দান করে আশীর্বাদ চাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। হাতিকে ব্যবহার করে জীবিকার উৎসের ধারণা তুলে ধরেন পরিচালক। এছাড়াও, সমুদ্র তীরবর্তী স্থান হওয়ায় জীবিকা নির্বাহের আরেকটি মাধ্যম হিসেবে জেলেদের জীবনকে দেখানো হয়, ধোপার জীবনকেও সংযুক্ত করা হয়। তথ্যচিত্রটির ১৫ মিনিট ২০ সেকেন্ডে দেখানো হয় কুমোরের মৃৎশিল্পের কাজ। নারী পুরুষের সহায়তায় পরিবেশবান্ধব কাজটি অন্যতম প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। এরপর কামারের কাজকে তুলে ধরেন, তারা ছিলেন পরিশ্রমী এবং উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী। রাজমিস্ত্রীর কাজের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে শিশুদের কাজের সহায়তার দৃশ্যটি সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। জেলেদের একাগ্রচিত্তে কাজ এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় জাল বুননের দক্ষতা দেখা যায় সেখানে। ভাত যেহেতু প্রধান খাদ্য ছিলো সিলনের জনগোষ্ঠীতে তাই ধান উৎপাদনের তাগিদ ছিলো অনেক বেশি। ধান লাগানো, তার পরিচর্যা, মাড়ানো, শুকানো এবং খাদ্য উপযোগী করে তুলতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও অংশগ্রহণ দেখা যায়। বিনোদনের উৎস হিসেবে শিশুদেরকে দেখা যায় নাচের শিক্ষকের কাছে ক্লাস করতে আসতে। তারা শৈশব থেকেই নানা শারীরিক কসরতের মাধ্যমে নাচের প্রশিক্ষণ পেতে থাকে। তাল ও লয়ের সংযোগে অনবদ্য কলা খুঁজে পাওয়া যায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিশুরা তা রপ্ত করতে থাকে। বিভিন্ন পেশার মানুষের একত্রে বসবাস এবং স্বাধীনচেতা জীবনের হাতছানি সেখানে দেখা যায়। কর্ম করে খাওয়া মানুষের মাঝে শান্তিতে বসবাসের চিত্রগুলোও তুলে ধরেন তিনি।
The Voices of Commerce:
এরপরের ভাগটি ‘The Voices of Commerce’ যা শুরু হয় ২৩ মিনিট ০২ সেকেন্ড থেকে। এই পর্বে রেলের আবির্ভাব এবং সিলনের ভূপ্রকৃতিকে দেখানোর মধ্য দিয়ে বোঝানো হয় ঔপনিবেশিকতার ছোঁয়া কিভাবে পাল্টে দিতে থাকে সে অঞ্চলের জনজীবন। হাতিকে ব্যবহার করে ভারী কাজ করানো হয়। আবার, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে ( প্রণাম করার মধ্য দিয়ে ) সিলনের একজন কর্মক্ষম বাসিন্দা গাছে উঠে নারিকেল সংগ্রহ করতে থাকেন। অর্থাৎ, ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখেই তিনি তার কাজে নামলেন তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এরই সাথে দেখানো হয় শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে জাহাজের আগমণ। কাঁচামাল নারিকেলের ব্যবহার পরবর্তীতে ঔপনিবেশিকরা তেল, ভিনেগার, সাবান বা জ্বালানী রূপে করতে থাকেন। স্থানীয় চাহিদা ব্যতিরেকে গরুর গাড়ি মারফত এবং তারপর জাহাজে করে অসংখ্য নারিকেল পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমের দেশগুলোতে। সে সমস্ত নারিকেল খোসা ছাড়িয়ে প্রস্তুত করে পাঠানো হয়। তথ্যচিত্রটির সম্পাদনের সময় তা গুরত্বের সাথে দেখানো হয়।
দুটি পাতা একটি কুঁড়ির মোহনীয় দ্রব্যটি হলো চা। চা ছিলো তৎকালীন সিলনের অন্যতম প্রধান একটি উৎপাদিত বস্তু। বাগানে নারী পুরুষের দিনভর পরিশ্রমের ফলে তোলা চা পাতার প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজন হতো ঔপনিবেশিকদের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির। পাতা থেকে গুড়ো চা প্রস্তুত প্রণালীগুলো স্থানীয়দের মাঝে শিখিয়ে দেন তারা। অতঃপর বড় বড় কার্টুনে ভরে তা পণ্যবাহী জাহাজে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমা দেশে। সিলন জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ পান সিলনের অনেক বাসিন্দা। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের বিস্তার ঘটাতে থাকেন ঔপনিবেশিকেরা।
The Appeal of a God:
সর্বশেষ অংশটি হলো- ‘The Appeal of a God’। এটি শুরু হয় ২৯ মিনিট ৪০ সেকেন্ড থেকে। হাতির উপর চলমান কয়েকজনকে দেখানো হয়। সমুদ্রপথে ব্যবসা প্রসারের খাতিরে ব্যবহৃত নৌকার নোঙর ও সিলনের জনসাধারণের জীবনে তার প্রভাবকে দেখানোর প্রচেষ্টা করা হয়। তথ্যচিত্রটির ৩১ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে দেখা যায় বিশাল বৌদ্ধমূর্তি এবং তার পাদদেশে একজন খেটে খাওয়া মানুষের ঈশ্বর-ভক্তির নিদর্শন। নিজ পরিশ্রমের ফলে উপার্জিত অর্থে অন্ন কিনে এনে, পবিত্র পোশাক পরিধান করে সৃষ্টিকর্তার সম্মুখে নিজেকে সমর্পণ করছেন তিনি যাতে মঙ্গল নেমে আসে ধরায় এবং নিজ জীবনে। অর্চনা শেষে পুনরায় কাজে ফেরার তাগিদে ছুটে চলেন। দৃশ্যমান মূর্তি দ্বারা অন্তত এটুকু বোঝা যায় সিলনের জনগোষ্ঠীরা অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন।
ধর্মকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিমিত্তে বিশেষ পোশাক ও গহনা পরিধান করে বাদ্যযন্ত্রের তালে নাচ ও স্তুতিবাণীর মাধ্যমে তা পরিবেশন করেন। বাড়ির উঠোনে এর আয়োজন করা হয়। ধারণা করে নেন তারা যে, এর মাধ্যমে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হবেন। এভাবেই বছরের পর বছর চলতি নিয়মে তাদের জীবনযাপন করতে থাকেন।
পুরো তথ্যচিত্রটি দেখার পর এ কথা উল্লেখ করা যায়, সিলনের জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের কাজের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কর্মকান্ডের একটি নিগূঢ় যোগসূত্র রয়েছে। কর্মঠ মানুষগুলোর জীবনে ঔপনিবেশিক প্রভাব একটি আমূল পরিবর্তন এনে দিলেও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি বরং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে। সিলন জনগোষ্ঠীর জীবনে তৎকালীন সময়ের সে সমস্ত বিষয়গুলোই সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘The song of Ceylon’ তথ্যচিত্রটিতে।

ফাতিমা তুজ-জান্নাত অনন্যা নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। আগ্রহের বিষয় ”visual and media studies, tourism, education and stress, cultural & social anthropology, migration & diaspora studies, body & sexuality, childhood and child rights, criminology, music and drama etc.” নিজেকে একজন গবেষক হিসাবে দেখতে চান। যোগাযোগ: ananna.stu2015@juniv.edu
Leave a Reply