পুষ্পিতা রায়
সামাজিক যোগাযোগের এই উৎকর্ষতার সময়ে আমাদের সামনে হয়ত খুব সহজেই উঠে আসছে মনের অনেক চাঁপা পড়ে থাকা কথাগুলো, যেগুলো কখনো বলা হয়ে উঠেনি নানাবিধ পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার কথা ভেবে অথবা কখনো হয়ত মনে হয়েছে কী বা লাভ এগুলো বলে? কেউ কি আছে শোনার অথবা বোঝার?
দেশ থেকে দূরে থাকলে মনে সবসময়ই কেমন একটা অজানা শঙ্কা কাজ করে নিজের কাছের মানুষগুলোর জন্য। দেশে থাকলেও এই অনিশ্চয়তাগুলো থাকে কিন্তু কিছুটা প্রচ্ছন্ন হয়ে। ভৌগলিক দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এই অজানা শঙ্কাগুলো প্রকট হয়ে উঠে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের নিউজ ফিড দেখে আমার শঙ্কার মাত্রা আমার মানসিক স্বাস্থ্যকে বেশ ভালোভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম বিভিন্ন রেষারেষির ঘটনাগুলো। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে তাই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি নেতিবাচক খবরগুলো। আজকেও সেটাই করছিলাম কিন্তু কারো একটা কমেন্টে চোখ আটকে যায়, তিনি লিখেছেন এগুলো ইদানিং কালের ঘটনা, আগে এগুলো ঘটতো না! কেন যেন আজকে আর মনটা ডাইভার্ট হচ্ছে না। পুরাতন স্মৃতি বার-বার আসছে যেটা আসলেই আমি মনেও করতে চাই না। কিন্তু আমার মনে হল কথাগুলো বলা দরকার, নিজের ভিতরে এই দুঃসহ অভিজ্ঞতাগুলো কাউকে সজ্জাবিন্যাস করে মুখে বলতে আমি অনেকটাই অপারগ, তাই লিখিত আকারেই মনের ব্যথাগুলো তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম।

তখন মালিবাগের বাসায় থাকতাম আমরা (সাল ১৯৯৩/৯৪), দশতালা বিল্ডিঙের আমরাই একমাত্র হিন্দু পরিবার ছিলাম। আমি তখন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হইনি, হিন্দু-মুসলিম কি জিনিস জানতাম না! একদিনের ঘটনা, আমাদের বাসায় হুট করে একটা টিয়া পাখি পেয়ে যাই আমরা এবং এরপর আমার সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থাকে নতুন এই অতিথিকে ঘিরে। হঠাৎ করে একদিন আমাদের পাশের বাসার বান্ধবী এবং ওদের গৃহ সহায়িকা (বয়স ১৩/১৪ হবে) আমাকে বলে এই পাখি হিন্দু না মুসলিম! আমি মোটামুটি জীবনে প্রথমবার এই প্রশ্ন শুনে তাজ্জব এবং সাথে সাথেই মা বাবার কাছে প্রশ্ন, এই জিনিস কী? মা হাসতে থাকে শুনে কিন্তু বলেনি এর মানে কি, শুধু বলে আমরা তো জানি না ওদের বল যেটা মনে হয় ভেবে নিতে।
আমিও বিষয়টা পাত্তা না দিয়েই দিন কাটাই। এরপর শুরু হয় আরেক যন্ত্রণা, একের পর এক চিঠি আসতে থাকে ওদের কাছ থেকে যেখানে মূল প্রসঙ্গ আমরা হিন্দু, আমরা পূজা করি যেটা খুবই খারাপ জিনিস, আমরা গরু খাই না যেটা খুবই সুস্বাদু, মূর্তি খারাপ আরো অদ্ভূত সব কাহিনী ভর্তি। আমি পড়তেও পারতাম না, আমাদের বাসায় যেই পিসি দেখাশোনা করতো তিনিই পড়ে শোনাতেন। আমি হা করে শুনতাম, সন্ধ্যায় মা অফিস থেকে আসতো, পিসি বিচার দিত। মা প্রথম দিকে গুরুত্ব দিত না কিন্ত নিয়মিত ঘটার কারণে বাধ্য হয়ে পাশের বাসার আন্টিকে জানান। এর পর আর চিঠি আসতো না, কিন্তু ঠিক বুঝতাম খেলায় আমাকে কিছুটা এড়ানো চেষ্টা হত। আমি তো দ্বিগুণ উৎসাহে আরো খেলতে চাইতাম (ধ্যান জ্ঞান সবই ছিল কখন ছাদে গিয়ে খেলব!) আরেকদিনের ঘটনা, পাশের বাসায় হুজুর পড়াতে আসতো, আমাকেও একদিন নিয়ে যাওয়া হল হুজুরের কাছে। হুজুর আমি হিন্দু শুনে আমাকে মুসলিম বানানোর জন্য কলেমা পড়তে বললেন, আমিও মনের খুশিতে পড়ে ফেললাম। আমাকে বলা হল আমি আজ থেকে মুসলিম । হুজুরের কথা শুনে বাসায় গিয়েই মা কে ঘোষণা দিলাম আমি আজ থেকে মুসলিম হয়ে গেছি, মা আবারো হেসে বলল আচ্ছা খুব ভাল কথা!
চূড়ান্ত ঘটনা ঘটে যখন বিল্ডিং এ আমার আরেক বান্ধবীর মা এবং দাদী তার জন্মদিনে আমাকে আর আমার বোনকে গরুর মাংস খাইয়ে দেয়, না বুঝেই খেতে থাকি এবং যথারীতি পিসি এসে দুইবোনকে সেখান থেকে বাসায় নিয়ে আসে। সেই প্রথম মাকে আমি কাঁদতে দেখেছিলাম। মা এর কান্না দেখে আমিও শুধুই কাদছিলাম না বুঝেই। মা আমাকে নিজের শরীর ছুইয়ে প্রতিজ্ঞা করালো ওদের বাসায় যেনো আর না যাই, আমিও তাই করলাম। কিন্তু কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারিনি সেদিন। পরে বাবা আসলে, মা কী বলল জানি না কিন্তু এর পর আমাকে নিয়ে ছোটখাট মিটিং বসানো হল এবং আমাকে শেখানো হল কোথাও খেতে গেলে সবার আগে জিজ্ঞেস করতে এটা কিসের মাংস, শুধু মুরগী হলেই খাব এবং আমাকে মুরগির রান চেনানো হল যাতে ভুল না করি। আমার ভেতর সেই ভয় এতটাই গাঢ় ছিল আমি প্রতিবার স্টার কাবাবের কাচ্চি খেতে যেয়েও জিজ্ঞেস করতাম এটা খাসির মাংসই তো?
স্কুলে এসেম্বলিতে সবাই মোনাজাত ধরতো আমিও তাই করতাম। একদিন সঙ্গীতা ম্যাডাম বলেন মোনাজাত ধরবে না, হাতজোড় করে থাকো! আবারো সেই না বুঝে তাই করা। আস্তে আস্তে ধর্ম ক্লাস আলাদা হবার মাধ্যমে আমি এই ধর্মের পার্থক্য বুঝতে পারি, নিজেকে আলাদা মনে হত যখন ধর্ম পরীক্ষায় সবার প্রশ্ন থাকতো একরকম আর আমারটা আসতো ৫/৭ মিনিট দেরিতে ম্যাডাম নিজে হাতে লিখে নিয়ে আসতো।
আমরা বর্তমান বাসায় (সিদ্ধেশ্বরী) শিফট হবার পর ঘটে আরো নোংরা ঘটনা। মা-বাবার রুমের জানালা আর পাশের দোতালা বাড়ির ছাদ খুব কাছাকাছি ছিল। এখানে এসেও টের পাই পুরো বিল্ডিং এ আমরা একাই হিন্দু পরিবার। পাশের বিল্ডিং এই বিষয়টা কিভাবে জানি জেনে গেল এবং ওদের মালি, বাসার কেয়ারটেকার সহ অনেকে মিলে শুরু করল অশালীন কর্মকান্ড। দিনে রাতে ছাদে দাড়িয়ে ‘‘মালু” বলে চিল্লাচিল্লি সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগালি। এমনও হয়েছে দাঁড়িয়ে মাস্টারবেট করতো আর হিন্দুদের গালি দিত। মা বাবা এখনও নিশ্চুপ, তাদের ঘরে দুই মেয়ে তার উপর ভাড়া-বাসা! তারা তেমন কিছুই বলেনি তখন। একদিন আমার কোচিং এ যাবার পথে রাস্তায় আমাকে খুব খারাপ ভাষায় গালি দেয় আর বাজে অঙ্গভঙ্গি করে এর পর শুনেছিলাম বাবা দারোয়ানকে ডেকে প্রচন্ড বকাঝকা করে যার ফলে অত্যাচার কিছুটা কমে।
ইউনিভার্সিটিতেও এমন অনেক বিচ্ছিন্ন (!) ঘটনা ঘটেছে, কোন সময় প্রতিবাদ করেছি, কোন সময় এড়িয়ে চলেছি। এখনো মনে আছে, পাসপোর্ট করার সময় আমাকে আর মাকে বলেছিল আপনারা এখানে কেন পড়ে আছেন? ভারতে চলে গেলেই পারেন। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্যই মা শাখা পড়া ছেড়ে দিল, কারণ রাস্তায় আসতে যেতে রিকসাওয়ালা থেকে শুরু করে সবাই অভদ্র কথাবার্তা বলত। এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর জন্যই মা চাইতো আমি যাতে দেশে না থাকি!
এগুলো আমার ভিতরে জমে ছিল, বলতে ইচ্ছা করতো না। খুব কাছের কয়েকজন বাদে কাউকে তেমন বলা হয়নি কখনো। মনে আসলেই অন্যচিন্তা শুরু করতাম। এড়িয়ে যেতে যেতে আজকে স্মৃতিগুলো ধাক্কা দিল, নিজেই নিজের মনকে বললাম এগুলো একদিনে হয়নি। ধর্মীয় রেষারেষি একদিনের না কিংবা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনাও না। অনেকদিনের পুঞ্জীভূত ধর্মীয় গোড়ামী আজকের বিশাল রুপ ধারণ করেছে । ভয় হয়, সকলের প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা এই দানব ভবিষ্যতে না গ্রাস করে পুরো দেশকে!

পুষ্পিতা রায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেছেন। এখন জার্মানীর Rhine-Waal University of Applied Sciences এ আরেকটি এম এ করছেন ।
Leave a Reply